মঙ্গলবার, নভেম্বর ০৩, ২০০৯

সরকারের দখলে থাকা অর্পিত সম্পত্তি বৈধ মালিকেরা ফিরে পাবেন

অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন (সংশোধন) ২০০৯ মন্ত্রিসভার চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে। সংসদে আইনটি পাস ও কার্যকর হলে সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা সব অর্পিত সম্পত্তি বৈধ মালিকের ফেরত পেতে আর কোনো বাধা থাকবে না।
সংশোধিত আইন অনুযায়ী, সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা অর্পিত সম্পত্তি বৈধ মালিকেরা ফেরত পেতে কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত ট্রাইব্যুনালে দাবিনামা পেশ করতে পারবেন। ট্রাইব্যুনাল বিচার-বিশ্লেষণ করে যে রায় দেবেন, তা চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।
গতকাল সোমবার সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠক হয়। বৈঠকে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন (সংশোধন) ২০০৯-এর চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। এ ছাড়া এসিড নিয়ন্ত্রণ আইন (সংশোধন), বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (সংশোধন) ও পরিবেশ আদালত আইন নীতিগত অনুমোদন করা হয়েছে। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর উপ প্রেস-সচিব মাহবুবুল হক সংবাদ ব্রিফিংয়ে আলোচনার বিষয় সম্পর্কে সাংবাদিকদের অবহিত করেন।
অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন (সংশোধন): এ আইন সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হলে বিচারপতি গোলাম রাব্বানী বলেন, পুরো আইনটি কী, তা দেখে মন্তব্য করা যাবে। তবে যতটুকু জানা সম্ভব হয়েছে তাতে দেখা যায়, আইনে অর্পিত সম্পত্তির সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়নি। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, কোনো একটি পরিবারের চার অংশীদারের তিনজন ভারতে গেলে সেই তিনজনের সম্পত্তি অর্পিত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু আইন অনুযায়ী, যিনি বাংলাদেশে রয়েছেন তিনি পুরো সম্পত্তির মালিক হতে পারবেন। কারণ অবণ্টিত এজমালি সম্পত্তির ক্ষুদ্র অংশীদারও একজন হক দাবিদার। সে জন্য গোড়াতেই ঘোষণা থাকা দরকার, কোন সম্পত্তি অর্পিত বলে বিবেচনা করা হবে না।
বিচারপতি গোলাম রাব্বানী বলেন, ট্রাইব্যুনালকে আইন অনুযায়ী বিচারের সুযোগ দেওয়া হলে যেকোনো একজনকে পুরো সম্পত্তি প্রদানে রায় দিতে হবে এবং রাষ্ট্র সে সম্পত্তি বুঝিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে। বর্তমান আইনে যেভাবে বলা হচ্ছে, তাতে মামলা-জটিলতা বাড়বে। সমস্যার কোনো সমাধান হবে না; বরং যুগ যুগ ধরে নতুন নতুন মামলার উদ্ভব হবে।
আইনটি সম্পর্কে আইন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০০১ সালে এ আইন পাস হয়েছিল। আবার সাত বছর পর কেন আইনটি আনা হলো, কী কারণে ঘটেছে, আমি জানি না। এটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। আইনটি আমার কাছে এলে এ সম্পর্কে বলতে পারব।’
আইনে যা থাকছে: সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত সংশোধনী অনুযায়ী অর্পিত সম্পত্তির তালিকা প্রকাশে কোনো আইনি বাধা থাকবে না। ২০০২ সালে আইনটির একটি ধারা সংশোধন করে অর্পিত সম্পত্তির তালিকা প্রকাশের সময় অনির্দিষ্টকাল করে দেওয়া হয়। ২০০১ সালের আইনে আইন পাসের পরবর্তী ১৮০ দিনের মধ্যে অর্পিত সম্পত্তির সরকারি তালিকা প্রকাশের ব্যবস্থা ছিল। গতকাল মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত সংশোধনী অনুযায়ী আইনটি পাস হওয়ার ২১০ দিনের মধ্যে প্রত্যর্পণযোগ্য অর্পিত সম্পত্তির তালিকা প্রকাশের নির্দেশনা আছে। সম্পত্তির তালিকা প্রকাশের পরই এ আইনের কার্যকারিতা শুরু হবে।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, দেশে তালিকাভুক্ত মোট অর্পিত সম্পত্তির পরিমাণ ছয় লাখ ৪৩ হাজার ১৩৬ দশমিক ৯০ একর। এর মধ্যে প্রত্যর্পণযোগ্য সম্পত্তি এক লাখ ৯৭ হাজার ২১৪ দশমিক ১৪ একর। এসব সম্পত্তি বর্তমানে সরকারের দখলে আছে। বাকি চার লাখ ৪৫ হাজার ৯২২ দশমিক ৭৬ একর সম্পত্তি তালিকাভুক্ত হলেও তা সরকারের দখলে নেই।
সূত্র জানায়, আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনী অনুযায়ী ব্যক্তিগত দখলে থাকা তালিকাভুক্ত অর্পিত সম্পত্তিতে (চার লাখ ৪৫ হাজার ৯২২ দশমিক ৭৬ একর) যাঁদের দাবি আছে তাঁদের সংশ্লিষ্ট উপজেলা, জেলা ও মহানগর কমিটিতে আবেদন করতে হবে। দাবির সপক্ষে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র কমিটিকে দেখাতে হবে। উপজেলা কমিটি সুপারিশ করলে আবেদনকারী জেলা কমিটিতে যাবেন। জেলা কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সম্পত্তি অবমুক্ত করা হবে। যে সম্পত্তিতে কারও দাবি বৈধ বলে গৃহীত হবে না, তা সরকারের খাস খতিয়ানভুক্ত হয়ে যাবে।
সূত্র জানায়, সংশোধনীতে তালিকাভুক্ত সম্পত্তির বিরোধ নিরসনের জন্য তিন পর্যায়ে যাচাই-বাছাই কমিটির কথা বলা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) নেতৃত্বে উপজেলা কমিটি, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) নেতৃত্বে জেলা কমিটি থাকবে। সংশ্লিষ্ট সাংসদেরা কমিটির উপদেষ্টা থাকবেন। এ ছাড়া ভূমিসচিবকে প্রধান করে নয় সদস্যের একটি কেন্দ্রীয় কমিটি থাকবে। ভূমিমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী এ কমিটির উপদেষ্টা থাকবেন।
সূত্র জানায়, উপজেলা কমিটির সিদ্ধান্তে কেউ অসন্তুষ্ট হলে তিনি জেলা কমিটি এবং পরে কেন্দ্রীয় কমিটিতে আবেদন করতে পারবেন। উপজেলা কমিটি ১২০ দিন, জেলা কমিটি ৩০ দিন এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় কমিটিকে ৯০ দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত দিতে হবে।
তত্কালীন পাকিস্তান সরকার ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলস অনুসারে ১৯৬৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যেসব নাগরিক পাকিস্তান ত্যাগ করে ভারতে চলে যান, তাঁদের রেখে যাওয়া সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে শত্রু সম্পত্তির নাম পরিবর্তন করে অর্পিত সম্পত্তি করা হয়।
অর্পিত সম্পত্তির দীর্ঘদিনের সমস্যা নিরসনের জন্য বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ২০০১ সালের ১১ এপ্রিল অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন করে। ২০০২ সালে বিএনপি সরকার আইনটির কতিপয় ধারার সংশোধন করায় প্রত্যর্পণযোগ্য অর্পিত সম্পত্তির তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়নি।
বাংলাদেশ প্রাইভেট সেক্টর ইনফ্রাস্ট্রাকচার গাইডলাইনস সংশোধন: এ ছাড়া গতকালের মন্ত্রিসভার বৈঠকে বাংলাদেশ প্রাইভেট সেক্টর ইনফ্রাস্ট্রাকচার গাইডলাইনস সংশোধন করা হয়। উপ প্রেস-সচিব জানান, সংশোধনী অনুযায়ী দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ (বুয়েট) দেশের সব প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি থাকবেন।
(সৌজন্যে: প্রথম আলো, ০৩ নভেম্বর ২০০৯)

কোন মন্তব্য নেই: