সোমবার, অক্টোবর ১০, ২০১১

'ওয়াগ্যোয়ে পোয়েহ্': রাখাইন সম্প্রদায়ের প্রবারণা উৎসব

গামী ১২ অক্টোবর, বুধবার শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা (রাখাইন ভাষায় 'ওয়াগ্যোয়ে লাব্রে')। প্রবারণা পূর্ণিমা বা 'ওয়াগ্যোয়ে লাব্রে' উপলক্ষ্যে যে উৎসব হয় তাকে রাখাইনরা বলে 'ওয়াগ্যোয়ে পোয়েহ্'। এটি রাখাইনদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। 'ওয়া' শব্দের অর্থ হচ্ছে বর্ষাবাস আর 'গ্যোয়ে' বা 'ক্যোয়ে' শব্দের অর্থ পরিসমাপ্তি। অর্থাৎ 'ওয়াগ্যোয়ে'-এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে 'ফুংগ্রী' বা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের তিন মাসব্যাপী বর্ষাব্রত পালনের পরিসমাপ্তি। আষাঢ়ি পূর্ণিমার ('ওয়াছো লাব্রে') পরদিন বৌদ্ধ ভিক্ষুদের তিন মাসব্যাপী 'ওয়া' বা বর্ষাব্রত পালন শুরু হয়। আর প্রবারণা তথা আশ্বিনি পূর্ণিমার ('ওয়াগ্যোয়ে লাব্রে') দিন তা শেষ হয়।

এখানে উল্লেখ্য, বুদ্ধপূর্ণিমা তথা বৈশাখি পূর্ণিমার ('কাছুং লাব্রে') মতো আষাঢ়ি পূর্ণিমাও তথাগত বুদ্ধের ত্রিস্মৃতি বিজড়িত। আষাঢ়ি পূর্ণিমার দিনেই রাজকুমার সিদ্ধার্থ গৌতমের মাতৃগর্ভে প্রতিসন্ধি গ্রহণ, ঊনত্রিশ বছর বয়সে গৃহত্যাগ এবং বুদ্ধত্ব লাভের পর ধর্মচক্র প্রবর্তন সংঘটিত হয়েছিল। এ জন্য প্রত্যেক বৌদ্ধের কাছে আষাঢ়ি পূর্ণিমা তিথিটি বিশেষ স্মরণীয়।

রাখাইনরা আজ থেকে 'ওয়াগ্যোয়ে পোয়েহ্' উদযাপন করছে। এই ঐতিহ্যবাহী উৎসবটি সাধারণত পূর্ণিমা তিথি থেকে কৃষ্ঞপক্ষের চতুর্থী পর্যন্ত মোট পাঁচদিন (এলাকাবিশেষে তিনদিন) স্থায়ী হয়। উৎসবের প্রথম দিন (পূর্ণিমার দিন) রাখাইন তরুণ-তরুণীরা নতুন জামাকাপড় পরে 'কেয়াং' বা বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে পুষ্পপূজা (বিশেষ করে শাপলা ফুল) করে থাকে। এই পুষ্পপূজা বা ফুল উৎসর্গ অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন হয় পূর্ণিমার দিন খুব ভোরে। সেদিন ভগবান বুদ্ধকে উদ্দেশ্য করে (বুদ্ধমূর্তির সামনে) বিভিন্ন ধরনের পিঠা-পায়েসও উৎসর্গ করা হয়। এখানে উল্লেখ্য, পূর্ণিমার দিন খুব ভোরে রাখাইনদের ঘরে-ঘরে হরেক রকম পিঠা-পায়েস বানানো হয়। তৈরি করা পিঠার প্রথমাংশ অর্থাৎ অগ্রভাগ বুদ্ধের উদ্দেশে উৎসর্গ করার পর অবশিষ্টাংশ দিয়ে প্রতিবেশীদের আপ্যায়ন করা হয় কিংবা তাদের (প্রতিবেশীদের) ঘরে-ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

পূর্ণিমার দিন সন্ধ্যা থেকে (এলাকাবিশেষে বিকাল থেকে) রাত অবধি 'ঔপোগো' (জল দেবতা)-এর উদ্দেশে বাঁশ ও রঙিন কাগজ দিয়ে তৈরি বৃহদাকার 'রিছিমিং'/'বগোহ্' (কল্পমন্দির) ভাসানো হয় নদী বা খালে। ওই কল্পমন্দিরে প্রতিঘাটে অপেক্ষমান নারী-পুরুষ সবাই মোমবাতি জ্বেলে জল দেবতাকে প্রণাম জ্ঞাপন করে। এ সময় কল্পমন্দির ভাসিয়ে নিয়ে আসা তরুণদল নৌকায় বসে গান-বাজনা করে। কল্পমন্দিরের সংখ্যা একাধিক হলে অংশগ্রহণকারী পক্ষগুলো 'ছেঙ্গ্যাই' (এক প্রকার স্লোগান, যা তরুণদল নেচে-নেচে গেয়ে থাকে)-এর মাধ্যমে স্বীয় পক্ষের কল্পমন্দিরের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে থাকে। এ সময় এক পক্ষ থেকে অন্য পক্ষকে ব্যঙ্গ করেও 'ছেঙ্গ্যাই' গাওয়া হয়। ইদানীং কল্পমন্দির ভাসানোর সময় সজীব গান-বাজনা বা 'ছেঙ্গ্যাই-এর পরিবর্তে রেকর্ড করা রাখাইন 'রোঃরা সাখ্রাং' বা লোকসংগীত মাইকে বাজাতে শোনা যায়। কল্পমন্দির ভাসানোর দৃশ্য উপভোগ করার জন্য রাখাইনদের পাশাপাশি ভিন্ন সম্প্রদায় এবং ধর্মের লোকেরাও কক্সবাজার জেলার রাখাইন অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় (বিশেষ করে চকরিয়ার হারবাং রাখাইন পাড়া, মহেশখালির গোরকঘাটা এবং রামু) ভিড় জমায়।

পাঠক, ইচ্ছা করলে আপনিও চলে আসতে পারেন চকরিয়ার হারবাঙে কিংবা রামুতে এবং দেখতে পারেন আজকের অনুষ্ঠান। প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংবাদকর্মী বন্ধুরাও রাখাইন সম্প্রদায়ের এই বর্ণাঢ্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান কাভার করতে পারেন উল্লিখিত স্পটে এসে কক্সবাজার পৌরবাসী রাখাইনরা কল্পমন্দির ভাসায় না। তারা প্যাগোডা বা চৈত্য-প্রাঙ্গণে বাঁশ ও রঙিন কাগজ দিয়ে তৈরি অস্থায়ী মণ্ডপে বুদ্ধমূর্তি স্থাপন পূর্বক প্রদীপ পূজা বা বুদ্ধপূজা করে। এ সময় তরুণ-তরুণীরা (সাধারণত সাংগঠনিকভাবে) গৃহী পূজারিদের কোমল পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন করে।

প্রবারণা পূর্ণিমার রাতে বৌদ্ধ বিহার প্রাঙ্গণে ফানুস বা আকাশ প্রদীপ (রাখাইন ভাষায় 'মিলুং' বা 'হ্মেয়িং') ওড়ানো হয়। রঙিন ফানুস বা আকাশ প্রদীপ ওড়ানোর অর্থ হচ্ছে ভাবী বুদ্ধ কুমার সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগের পর চুল কাটার ঘটনাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা। সেদিন রাতে বৌদ্ধ বিহার, সীমাঘর এবং চৈত্য বা প্যাগোডাগুলোয় মোমবাতি বা বিজলি বাতি জ্বেলে আলোকসজ্জা করা হয়।

'ওয়াগ্যোয়ে' উৎসবের অন্যান্য দিনে ধর্মীয় শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। শোভাযাত্রার উদ্দেশ্য হচ্ছে এলাকার বাভিন্ন বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে পিণ্ড বা অর্ঘ্য দান করা। শোভাযাত্রার শেষে নিজেদের সমাজের 'কেয়াং' বা বৌদ্ধ বিহারে সমবেত হয়ে সবাই পঞ্চশীল গ্রহণ করে। প্রবারণা পূর্ণিমার পরদিন থেকে পরবর্তী পূর্ণিমা অর্থাৎ কার্তিকি পূর্ণিমা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রতিটি বৌদ্ধ গ্রামে 'কাথিং পোয়েহ্' (দানোত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব) উদযাপিত হয়ে থাকে। এই 'ওয়াগ্যোয়ে পোয়েহ্'-র আবেদন রাখাইনদের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সবদিক দিয়ে বিবেচনা করলে 'ওয়াগ্যোয়ে' একটি তাৎপর্যপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব।

[রাখাইন সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব 'ওয়াগ্যোয়ে পোয়েহ্' নিয়ে আমার লেখা একাধিক সচিত্র ফিচার ইতিপূর্বে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্য থেকে 'ভোরের কাগজ'-এ (৫ অক্টোবর ১৯৯৮, সোমবার) প্রকাশিত লেখাটি কিঞ্চিৎ (দিন-তারিখ) পরিবর্তন করে এখানে দিলাম।]