শুক্রবার, নভেম্বর ১৯, ২০১০

'মহা কাথিং পোয়েহ' তথা দানোত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব


থাগত বুদ্ধের মতে এ জগতে সুখের চেয়ে দুঃখই বেশি। বৌদ্ধদর্শন মতে অবিদ্যাই দুঃখের মূল কারণ। অবিদ্যা বা অজ্ঞতা বলতে সত্য সম্পর্কে অজ্ঞতা বোঝায়। এই অজ্ঞতার কারণে পৃথিবীতে মানুষ বার-বার জন্মগ্রহণ করে এবং দুঃখ ভোগ করে। বৌদ্ধ ধর্ম মতে এটা মানুষের কৃতকর্মের ফল।

কর্মবাদ হল শর্তাধীন সৃষ্টিবাদের প্রকাশ। মহামতি বুদ্ধ বলেছেন, ভালো কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে পুণ্য বা 'পারমী' অর্জন করতে হবে এবং সমুদয় 'পারমী' অর্জিত হলেই নির্বাণলাভ সম্ভব। এ নির্বাণই হচ্ছে দুঃখ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় বা পথ। নির্বাণ কিন্তু মৃত্যু নয়, মৃত্যুতে দুঃখের নিবৃত্ত হয় না। দুঃখ থেকে মুক্তির জন্য নিরন্তরভাবে মানুষের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। 'পারমী' পূরণ বা অর্জন করা এ প্রচেষ্টারই অংশ। দশটি 'পারমী'র মধ্যে দান 'পারমী'ই শ্রেষ্ঠ।
বৌদ্ধ সাহিত্যে দানের একটি স্বরূপ আমরা লক্ষ করি 'ওয়েসেংদ্রা' জাতকে। গৌতম বুদ্ধত্ব লাভের আগে 'পারমী' পূরণ করতে-করতে পাঁচশো পঞ্চাশ (৫৫০) বার ইহজগতে জন্মগ্রহণ করেন বিভিন্ন প্রাণী রূপে। 'ওয়েসেংদ্রা' জাতক পর্যায়ে তিনি 'রাজা বেসন্তর' রূপে জন্মগ্রহণ করেন। দানশীল রাজা হিসাবে জীবনের সর্বস্ব দান করে রিক্তহস্তে বনবাসে যাওয়ার আগে তিনি প্রিয় দু'সন্তান 'গনা' ও 'জালী'কে 'যুজগা পুংন্নাহ' (যোজন ব্রাহ্মণ)-এর কাছে দান করেছিলেন। 'রাজা বেসন্তর' পরবর্তী জন্মে রাজপুত্র 'সিদ্ধার্থ গৌতম' রূপে জন্ম লাভ করেন এবং ঊনত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর পর্যন্ত টানা ছ'বছর কঠোর সাধনার পর বুদ্ধত্ব লাভ করেন।

কথিত আছে, তথাগত বুদ্ধ এক প্রবারণা পূর্ণিমার প্রক্কালে 'সাওয়েথি' (শ্রাবস্তী) তে অবস্থান করছিলেন। তখন মহৌপাসিকা 'ওয়িসাংখা' (বিশাখা) বুদ্ধের কাছে জানতে চান যে, পৃথিবীতে যতোরকমের দানকর্ম প্রচলিত আছে তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ দানকর্ম কোনটি। বুদ্ধ জানালেন, কঠিন চীবর দানই শ্রেষ্ঠ দান অর্থাৎ মহাদান। এই দানের মাধ্যমে একজন 'পারমী'পূর্ণ মহিলা পরজন্মে পুরুষ রূপে জন্ম লাভ করতে পারে। বুদ্ধের কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে বিশাখা চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তুলা থেকে সুতা কেটে, রং করে, কাপড় বুনে এবং চীবর সেলাই করে ভিক্ষু সংঘকে দান করেছিলেন।
এ দিকে বাংলাদেশি বৌদ্ধদের কাছে কঠিন চীবর দানের পটভূমি সম্বন্ধে যে বিবরণ পাওয়া যায় তা এ রকম : তথাগত বুদ্ধ 'সাওয়েথি' (শ্রাবস্তী)-তে অবস্থানকালে ত্রিশজন পাবেয্যবাসী ভিক্ষু বর্ষাবাস শেষে বুদ্ধ দর্শনের জন্য সেখানে এসে পৌঁছান। বর্ষাবাসের তিনমাস একটানা ব্যবহারের ফলে ভিক্ষুদের পরিধেয় বস্ত্র অর্থাৎ চীবর তখন একেবারে জীর্ণ হয়ে পড়ে। কথিত আছে, মহৌপাসিকা 'ওয়িসাংখা' (বিশাখা)-র জনৈক পরিচারিকা আহারের জন্য ওই ভিক্ষুদের আহ্বান করতে বিহারে গেলে তাঁদেরকে নগ্নগায়ে স্নানরত দেখতে পায়। বিষয়টি মহৌপাসিকা বিশাখাকে জানানো হলে তিনি স্বয়ং বুদ্ধের কাছে গিয়ে ভিক্ষুদের পরিধেয় বস্ত্রের শোচনীয় জীর্ণদশার কথা জানান। তখন বিশাখা বুদ্ধের উপদেশ অনুযায়ী এক অহোরাত্রির মধ্যেই বিপুল অর্থ ব্যয়ে যথেষ্ট সংখ্যক চীবর প্রস্তুত করে ভিক্ষুদের দান করেন।

কঠিন চীবর দান করা হয় বছরে একবার। প্রবারণা পূর্ণিমার পরদিন থেকে পরবর্তী পূর্ণিমা অর্থাৎ কার্তিকি পূর্ণিমা (আগামী ২১ নভেম্বর ২০১০, রবিবার কার্তিকি পূর্ণিমা) পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রতিটি বৌদ্ধ গ্রামে 'মহা কাথিং পোয়েহ' (দানোত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব) উদযাপিত হয়ে থাকে। থেরবাদী বৌদ্ধদের কাছে কঠিন চীবর দানই সর্বোত্তম দান। প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে বুদ্ধ-শিষ্যা মহৌপাসিকা বিশাখা প্রবর্তিত এই দানোত্তম উৎসবকে উপমহাদেশের বৌদ্ধরা জাঁকজমকভাবে উদযাপন করে থাকে। এখানে উল্লেখ্য, যে বৌদ্ধ বিহারে বর্ষাব্রত পালন করা হয়নি সেই বিহারে কঠিন চীবর দানোৎসব উদযাপিত হতে পারে না।

বুদ্ধের সময় ভিক্ষুরা শ্মশানে বা পথে-প্রান্তরে ফেলে দেওয়া পুরনো কাপড় সংগ্রহ ও সেলাই করে পরতেন। বর্তমানে ভিক্ষুরা বিশেষভাবে সেলাই করা গৌরিক বস্ত্র (চীবর) পরে থাকেন। ভিক্ষুরা এক সঙ্গে তিনটি মাত্র চীবর পরতে পারেন। চীবরগুলো হল : অন্তর্বাস বা পরিধেয় বস্ত্র, উত্তরাসঙ্গ বা বহির্বাস এবং সংঘাটি বা দোয়াজিক। রাখাইন ভাষায় এই তিনটি চীবরকে বলা হয় যথাক্রমে 'সাংবাইং', 'সাংঘেং' এবং 'ধূগউ' বা 'কোদাং'। এই তিনটি চীবরের যে-কোনো একটি বা একাধিক দ্বারা কঠিন চীবর দান করতে হয়। 'কঠিন চীবর' নামের তাৎপর্য হচ্ছে, চীবর তৈরি করা অর্থাৎ তুলা থেকে সুতা কাটা, কাপড় বোনা, নির্দিষ্ট নিয়মে কাপড় কেটে বিশেষভাবে সেলাই করা, রং করা ইত্যাদি কাজ চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে অর্থাৎ অরুণোদয় থেকে পরদিন অরুণোদয় পর্যন্ত সময়ের মধ্যেই সমাপন করা। মোট কথা, কঠিন নিয়ম অনুসরণ করে চীবরটি প্রস্তুত করতে হয় বলে এর নাম 'কঠিন চীবর' ('কাথিং সাংঘেং')।

আমাদের দেশে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা সদরের রাজবাড়িস্থ রাজবন বিহারে বিশাখা প্রবর্তিত নিয়মে কঠিন চীবর দানোৎসব উদযাপিত হয়ে থাকে। রাঙামাটির রাজবন বিহার ছাড়া দেশের বৌদ্ধ অধ্যুষিত অন্যান্য এলাকায় সাধারণত পূর্বে প্রস্তুত চীবর দিয়ে কিংবা তৈরি করা চীবর কিনে কঠিন চীবর দান করা হয়ে থাকে। এই চীবরগুলো সাধারণত মিয়ানমার থেকে আসে।