শুক্রবার, নভেম্বর ১৯, ২০১০

'মহা কাথিং পোয়েহ' তথা দানোত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব


থাগত বুদ্ধের মতে এ জগতে সুখের চেয়ে দুঃখই বেশি। বৌদ্ধদর্শন মতে অবিদ্যাই দুঃখের মূল কারণ। অবিদ্যা বা অজ্ঞতা বলতে সত্য সম্পর্কে অজ্ঞতা বোঝায়। এই অজ্ঞতার কারণে পৃথিবীতে মানুষ বার-বার জন্মগ্রহণ করে এবং দুঃখ ভোগ করে। বৌদ্ধ ধর্ম মতে এটা মানুষের কৃতকর্মের ফল।

কর্মবাদ হল শর্তাধীন সৃষ্টিবাদের প্রকাশ। মহামতি বুদ্ধ বলেছেন, ভালো কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে পুণ্য বা 'পারমী' অর্জন করতে হবে এবং সমুদয় 'পারমী' অর্জিত হলেই নির্বাণলাভ সম্ভব। এ নির্বাণই হচ্ছে দুঃখ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় বা পথ। নির্বাণ কিন্তু মৃত্যু নয়, মৃত্যুতে দুঃখের নিবৃত্ত হয় না। দুঃখ থেকে মুক্তির জন্য নিরন্তরভাবে মানুষের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। 'পারমী' পূরণ বা অর্জন করা এ প্রচেষ্টারই অংশ। দশটি 'পারমী'র মধ্যে দান 'পারমী'ই শ্রেষ্ঠ।
বৌদ্ধ সাহিত্যে দানের একটি স্বরূপ আমরা লক্ষ করি 'ওয়েসেংদ্রা' জাতকে। গৌতম বুদ্ধত্ব লাভের আগে 'পারমী' পূরণ করতে-করতে পাঁচশো পঞ্চাশ (৫৫০) বার ইহজগতে জন্মগ্রহণ করেন বিভিন্ন প্রাণী রূপে। 'ওয়েসেংদ্রা' জাতক পর্যায়ে তিনি 'রাজা বেসন্তর' রূপে জন্মগ্রহণ করেন। দানশীল রাজা হিসাবে জীবনের সর্বস্ব দান করে রিক্তহস্তে বনবাসে যাওয়ার আগে তিনি প্রিয় দু'সন্তান 'গনা' ও 'জালী'কে 'যুজগা পুংন্নাহ' (যোজন ব্রাহ্মণ)-এর কাছে দান করেছিলেন। 'রাজা বেসন্তর' পরবর্তী জন্মে রাজপুত্র 'সিদ্ধার্থ গৌতম' রূপে জন্ম লাভ করেন এবং ঊনত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর পর্যন্ত টানা ছ'বছর কঠোর সাধনার পর বুদ্ধত্ব লাভ করেন।

কথিত আছে, তথাগত বুদ্ধ এক প্রবারণা পূর্ণিমার প্রক্কালে 'সাওয়েথি' (শ্রাবস্তী) তে অবস্থান করছিলেন। তখন মহৌপাসিকা 'ওয়িসাংখা' (বিশাখা) বুদ্ধের কাছে জানতে চান যে, পৃথিবীতে যতোরকমের দানকর্ম প্রচলিত আছে তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ দানকর্ম কোনটি। বুদ্ধ জানালেন, কঠিন চীবর দানই শ্রেষ্ঠ দান অর্থাৎ মহাদান। এই দানের মাধ্যমে একজন 'পারমী'পূর্ণ মহিলা পরজন্মে পুরুষ রূপে জন্ম লাভ করতে পারে। বুদ্ধের কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে বিশাখা চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তুলা থেকে সুতা কেটে, রং করে, কাপড় বুনে এবং চীবর সেলাই করে ভিক্ষু সংঘকে দান করেছিলেন।
এ দিকে বাংলাদেশি বৌদ্ধদের কাছে কঠিন চীবর দানের পটভূমি সম্বন্ধে যে বিবরণ পাওয়া যায় তা এ রকম : তথাগত বুদ্ধ 'সাওয়েথি' (শ্রাবস্তী)-তে অবস্থানকালে ত্রিশজন পাবেয্যবাসী ভিক্ষু বর্ষাবাস শেষে বুদ্ধ দর্শনের জন্য সেখানে এসে পৌঁছান। বর্ষাবাসের তিনমাস একটানা ব্যবহারের ফলে ভিক্ষুদের পরিধেয় বস্ত্র অর্থাৎ চীবর তখন একেবারে জীর্ণ হয়ে পড়ে। কথিত আছে, মহৌপাসিকা 'ওয়িসাংখা' (বিশাখা)-র জনৈক পরিচারিকা আহারের জন্য ওই ভিক্ষুদের আহ্বান করতে বিহারে গেলে তাঁদেরকে নগ্নগায়ে স্নানরত দেখতে পায়। বিষয়টি মহৌপাসিকা বিশাখাকে জানানো হলে তিনি স্বয়ং বুদ্ধের কাছে গিয়ে ভিক্ষুদের পরিধেয় বস্ত্রের শোচনীয় জীর্ণদশার কথা জানান। তখন বিশাখা বুদ্ধের উপদেশ অনুযায়ী এক অহোরাত্রির মধ্যেই বিপুল অর্থ ব্যয়ে যথেষ্ট সংখ্যক চীবর প্রস্তুত করে ভিক্ষুদের দান করেন।

কঠিন চীবর দান করা হয় বছরে একবার। প্রবারণা পূর্ণিমার পরদিন থেকে পরবর্তী পূর্ণিমা অর্থাৎ কার্তিকি পূর্ণিমা (আগামী ২১ নভেম্বর ২০১০, রবিবার কার্তিকি পূর্ণিমা) পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রতিটি বৌদ্ধ গ্রামে 'মহা কাথিং পোয়েহ' (দানোত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব) উদযাপিত হয়ে থাকে। থেরবাদী বৌদ্ধদের কাছে কঠিন চীবর দানই সর্বোত্তম দান। প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে বুদ্ধ-শিষ্যা মহৌপাসিকা বিশাখা প্রবর্তিত এই দানোত্তম উৎসবকে উপমহাদেশের বৌদ্ধরা জাঁকজমকভাবে উদযাপন করে থাকে। এখানে উল্লেখ্য, যে বৌদ্ধ বিহারে বর্ষাব্রত পালন করা হয়নি সেই বিহারে কঠিন চীবর দানোৎসব উদযাপিত হতে পারে না।

বুদ্ধের সময় ভিক্ষুরা শ্মশানে বা পথে-প্রান্তরে ফেলে দেওয়া পুরনো কাপড় সংগ্রহ ও সেলাই করে পরতেন। বর্তমানে ভিক্ষুরা বিশেষভাবে সেলাই করা গৌরিক বস্ত্র (চীবর) পরে থাকেন। ভিক্ষুরা এক সঙ্গে তিনটি মাত্র চীবর পরতে পারেন। চীবরগুলো হল : অন্তর্বাস বা পরিধেয় বস্ত্র, উত্তরাসঙ্গ বা বহির্বাস এবং সংঘাটি বা দোয়াজিক। রাখাইন ভাষায় এই তিনটি চীবরকে বলা হয় যথাক্রমে 'সাংবাইং', 'সাংঘেং' এবং 'ধূগউ' বা 'কোদাং'। এই তিনটি চীবরের যে-কোনো একটি বা একাধিক দ্বারা কঠিন চীবর দান করতে হয়। 'কঠিন চীবর' নামের তাৎপর্য হচ্ছে, চীবর তৈরি করা অর্থাৎ তুলা থেকে সুতা কাটা, কাপড় বোনা, নির্দিষ্ট নিয়মে কাপড় কেটে বিশেষভাবে সেলাই করা, রং করা ইত্যাদি কাজ চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে অর্থাৎ অরুণোদয় থেকে পরদিন অরুণোদয় পর্যন্ত সময়ের মধ্যেই সমাপন করা। মোট কথা, কঠিন নিয়ম অনুসরণ করে চীবরটি প্রস্তুত করতে হয় বলে এর নাম 'কঠিন চীবর' ('কাথিং সাংঘেং')।

আমাদের দেশে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা সদরের রাজবাড়িস্থ রাজবন বিহারে বিশাখা প্রবর্তিত নিয়মে কঠিন চীবর দানোৎসব উদযাপিত হয়ে থাকে। রাঙামাটির রাজবন বিহার ছাড়া দেশের বৌদ্ধ অধ্যুষিত অন্যান্য এলাকায় সাধারণত পূর্বে প্রস্তুত চীবর দিয়ে কিংবা তৈরি করা চীবর কিনে কঠিন চীবর দান করা হয়ে থাকে। এই চীবরগুলো সাধারণত মিয়ানমার থেকে আসে।

সোমবার, অক্টোবর ১১, ২০১০

পাহাড়িরা কি এভাবে উচ্ছেদ হতেই থাকবে?



বান্দরবানের লামা উপজেলার রূপসীপাড়া ইউনিয়নের ২৯৬ নম্বর নাইক্ষ্যং মৌজার ম্রো সম্প্রদায়ের লোকজন এখন ভালো নেই। বংশ পরম্পরায় যে-ভূমিতে তাদের চাষ-বাস সেখান থেকে তাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। বর্তমান শাসক দলের স্থানীয় কতিপয় নেতা-কর্মী (উল্লেখ্য, তারা সবাই বাঙালি) ম্রোদের ভোগদখলে থাকা জমি জবরদখল করে নিচ্ছে বলে গতকাল (শনিবার) সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ম্রো সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে চুমপং হেডম্যান তাঁর লিখিত বক্তব্যে অভিযোগ করেন, উপজেলার রূপসীপাড়া ইউনিয়নের ২৯৬ নম্বর নাইক্ষ্যং মৌজার ৯০ শতাংশ ভূমি সরকারি তৌজিতে খাস। ইউনিয়ন সদর থেকে অনেক দূরে গহিন পাহাড়ে ম্রো পল্লি। ম্রো সম্প্রদায়ের ২১৯ পরিবার প্রায় ১ হাজার ১০০ একর পাহাড়ি জমিতে বংশ পরম্পরায় জুম চাষসহ বিভিন্ন ফলজ-বনজ বাগান সৃজন করে ভোগ দখল করে আসছে। ম্রোরা শিক্ষায় পিছিয়ে, তাই ভূমির কাগজপত্র তৈরির নিয়ম-কানুন তাদের জানা নেই।

চুমপং হেডম্যান লিখিত বক্তব্যে আরও অভিযোগ করেন, জবর জবরদখলকারীরা ইতিমধ্যে ৪৫ ম্রো পরিবারকে উচ্ছেদ করেছে। অবশিষ্ট ১৭৪ পরিবারও উচ্ছেদ হওয়ার পথে। ভূমিদস্যুরা ম্রো সম্প্রদায়ের ভোগদখলে থাকা ভূমি রাতারাতি জবরদখল করে সেখানে বাড়িঘর তৈরি পূর্বক বাগান দখল করছে। জবরদখলে বাধা দেওয়ায় ম্রোদের গৃহপালিত গরু-ছাগল দা দিয়ে এলোপাতাড়ি জখম করে জুম চাষসহ বাগান সৃজনের কাজে বিভিন্ন ধরনের হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করছে।

ভূমিদস্যুদের জবরদখলের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য স্থানীয় প্রশাসনসহ প্রধানমন্ত্রীর দফ্তরেও অভিযোগ জানানো হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ম্রোরা জানান।

শুক্রবার, সেপ্টেম্বর ০৩, ২০১০

তাঁত: জেগে উঠেছে রাখাইনপল্লি

 
রগুনার বঙ্গোপসাগরের তীরে আদিবাসী রাখাইনপল্লিগুলোতে এখন উত্সবের আমেজ। বড় বড় কুপিবাতি জ্বালিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত চলছে তাঁতে কাপড় বোনার কাজ। দিন-রাতে এখন সমান ব্যস্ততা। সামনে ঈদ, তাই তাঁতগুলোর খটখট শব্দে পল্লিগুলো মুখর হয়ে উঠেছে। রংবেরঙের কাপড় বুনে সেগুলো দেশের বিভিন্ন স্থানের বাজারে পাঠানো থেকে শুরু করে সব কাজই করতে হচ্ছে রাখাইন নারীদের। তাঁদের এখন অবসর নেই।
    এখানে উত্পাদিত কাপড় যাচ্ছে ঢাকা, বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি আর কুয়াকাটার বাজারে। ঈদের ছুটিতে পর্যটকেরা কুয়াকাটা, রাঙামাটি, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে বেড়াতে আসবেন। পর্যটকদের চাহিদা অনুযায়ী এসব এলাকার ব্যবসায়ীরা আগেভাগেই আদিবাসী রাখাইনদের হস্তচালিত তাঁতে বোনা বাহারি রঙের কাপড় যেমন—থামি, লুঙ্গি, শার্টপিস, শাড়ি, গামছা, বিছানার চাদর, থ্রিপিস, হাতব্যাগ সংগ্রহ করছেন। এসবের জোগান দিতেই বেড়ে গেছে রাখাইনপল্লীবাসীর ব্যস্ততা।

    রাখাইন সমাজকল্যাণ সংস্থার সদস্য সচিব খে মংলা জানান, তালতলীর ১৩টি আদিবাসী পাড়ায় হাতে চালিত প্রায় ৩০০ তাঁত রয়েছে। এই তাঁতগুলো আদিবাসীদের ঐতিহ্যের ধারক। প্রায় ২০০ বছর ধরে তাঁত বুনে নিজেদের পরিধেয় কাপড়ের চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত কাপড় বিক্রি করে রাখাইনরা বাড়তি আয় করে জীবিকা নির্বাহ করছে। রাখাইনদের মধ্যে এমন রীতি ছিল যে, কোনো রাখাইন মেয়ে হস্তচালিত তাঁত বুনতে না পারলে সেই মেয়ের বিয়েই হতো না। এখন নানা করণে সেই রীতির পরিবর্তন ঘটেছে। অনেক পরিবার যেমন এখান থেকে বিলুপ্ত হয়েছে, তেমনি তাঁতগুলোও অচল হয়ে পড়েছে।

    খে মংলা আরও জানান, প্রতিকূলতার মধ্যেও তালতলী থানার তালতলীপাড়া, ছাতনপাড়া, মনুখেপাড়া, আগাঠাকুরপাড়া, সওদাগরপাড়া, তালুকদারপাড়া, কবিরাজপাড়া, তাঁতিপাড়া, লাউপাড়া ও অঙ্কুজানপাড়ায় রাখাইনপল্লিগুলোতে প্রায় ৩০০ হস্তচালিত তাঁত রয়েছে। ইদানীং রাখাইনদের তাঁতের কাপড়ের জনপ্রিয়তাও বেড়েছে। এতে তাঁতে আবার সুদিনের আভাস মিলেছে। তবে সুতার দুষ্প্রাপ্যতা ও মূল্য বৃদ্ধির কারণে তাঁতিরা তেমন লাভের মুখ দেখতে পাচ্ছেন না।

    তালতলীর আদিবাসী পল্লিগুলোতে গিয়ে দেখা গেল, তাঁতিদের কোলাহল আর কর্মব্যস্ততায় বোঝার উপায় নেই যে কদিন আগেও এসব পল্লির তাঁতগুলো নিষ্ক্রিয় পড়ে ছিল। ধুলাবালু আর মাকড়সার জঞ্জালে আচ্ছন্ন তাঁতঘরগুলো এখন পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি। চলছে খটখট শব্দ করে।

    তাঁতের দুর্দশা আর সম্ভাবনার কথা বলতে গিয়ে তালুকদারপাড়া রাখাইনপল্লির গৃহিণী মাচেজেন রাখাইন বলেন, ‘রাখাইন তাঁতিদের উত্পাদিত বস্ত্রের কদর দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের সর্বত্র থাকলেও ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, বাজারজাতকরণে সমস্যা এবং আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারায় এখানে তাঁতির সংখ্যা কমেছে। সুতার মূল্য বৃদ্ধি আর পুঁজির অভাব আমাদের মেরুদণ্ড সোজা করতে দিচ্ছে না।’

    রাখাইনদের হস্তচালিত তাঁতে বোনা কাপড়ে বাহারি ও ঝলমলে রঙের ব্যবহার এবং লতাপাতা, ফুল, পাখি ও প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গের অলংকরণ বৈচিত্র্য এনেছে এসব কাপড়ে। এ প্রসঙ্গে মাচেজেন বলেন, ‘রাখাইনরা ঐতিহ্যগতভাবেই সবকিছুতে রঙের জৌলুশ, প্রকৃতি ও জীবজন্তুর প্রতি বেশি সংবেদনশীল। পোশাকে ও সংস্কৃতিতে এটা বেশি পরিলক্ষিত হয়। এ জন্য তাঁতে বোনা কাপড়ে ছয় থেকে আট ধরনের রং আমরা ব্যবহার করি। এসব রং কৃত্রিম নয়, প্রকৃতি থেকে নেওয়া। যেমন সুতায় বিভিন্ন রং করতে আমরা শাল, বকুলসহ বিভিন্ন গাছের পাতা ও বাকল ব্যবহার করি। এতে রং খুব টেকসই হয়। পাশাপাশি বাজারের অন্য যেকোনো কাপড়ের তুলনায় আমাদের কাপড়ের রং থাকে আলাদা।’

    কুয়াকাটার পাইকারি কাপড় ব্যবসায়ী মংচান বলেন, ‘এখান থেকে কাপড় ও অন্যান্য পণ্য নিয়ে কুয়াকাটা, কক্সবাজারে পাঠাই। ঈদ সামনে রেখে কুয়াকাটা ও কক্সবাজারে এসব পণ্যের খুব চাহিদা এখন।’

    লোকসান গুনতে গুনতে রাখাইন তাঁতিরা একসময় ঋণে জর্জরিত হয়ে পুরোনো পেশা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁদের অনেকে আবার পুরোনো তাঁত সচল করেছেন। যাঁরা পোড় খেয়ে পূর্বপুরুষের এই পেশা ধরে রেখেছেন, তাঁরা আবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন।

    সৌজন্যে: প্রথম আলো, শুক্রবার, ০৩ সেপ্টম্বর ২০১০

    বৃহস্পতিবার, মে ২৭, ২০১০

    বুদ্ধ পূর্ণিমা ও রাখাইন সংস্কৃতি



    জ (২৭ মে) শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা। এ পূর্ণিমা তিথিটি বৌদ্ধদের পবিত্রতম তিথি। এ তিথিটি বৈশাখ মাসে না পড়লেও বৈশাখি পূর্ণিমা নামে খ্যাত। বৌদ্ধদের কাছে এটিই বুদ্ধ পূর্ণিমা। বুদ্ধ পূর্ণিমা মহামানব গৌতম বুদ্ধের ত্রিস্মৃতি বিজড়িত একটি পবিত্র দিন। বুদ্ধ পূর্ণিমা তিথিতেই নিষ্পন্ন হয়েছিল ভাবী বুদ্ধ কুমার সিদ্ধার্থের মাতৃকুক্ষি হতে নিষ্ক্রমণ, বুদ্ধত্ব লাভ এবং মহা পরিনির্বাণ। খ্রিস্টপূর্ব ৬২৩ অব্দের বৈশাখি পূর্ণিমা তিথিতে লুম্বিনী কাননের শালতরুতলে কুমার সিদ্ধার্থের জন্ম হয়। জন্মের পর বড়-বড় রাজজ্যোতিষীগণ রাজকুমার সিদ্ধার্থের জন্মপঞ্জিকা তৈরি করেন। পণ্ডিতগণ কুমার সিদ্ধার্থের মধ্যে মহাপুরুষোচিত বত্রিশটি সুলক্ষণ দেখতে পান। বৌদ্ধদের পবিত্রতম গ্রন্থ ত্রিপিটকে এর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। কুমার সিদ্ধার্থের জন্মের সাতদিন পর তাঁর গর্ভধারিনী মহামায়া বা মায়াদেবী অকষ্মাৎ দেহ ত্যাগ করেন। মায়ের মৃত্যুর পর সৎমা বা মাসি গৌতমীর (মহামায়া এবং গৌতমী পরস্পর সহোদরা, রাজা শুদ্ধোদন দু'জনকেই বিয়ে করেন) দ্বারা পালিত হন বলে কুমার সিদ্ধার্থের নাম হয় গৌতম। ঊনত্রিশ বছর বয়সে রাজকুমার গৌতম রাজসুখ ছেড়ে গৃহত্যাগী হন। দীর্ঘ ছ'বছর কঠোর সাধনার পর খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৮ অব্দে আর এক বৈশাখি পূর্ণিমা তিথিতে পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে উরুবেলার নৈরঞ্জণা নদীর তীরে বোধিদ্রুম বা অশ্বত্থবৃক্ষের তলে রাজকুমার সিদ্ধার্থ গৌতম 'বুদ্ধত্ব' লাভ করেন। মহামানব গৌতম বুদ্ধ আশি বছর বয়সে খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৩ অব্দে আর এক বৈশাখি পূর্ণিমায় কুশীনগরের মল্লদের শালবনে পরিনির্বাণ লাভ করেন।

    পরিনির্বাণের পর বুদ্ধের দেহাবশেষ দ্রোণ নামের এক ব্রাহ্মণ মগধের অজাতশত্রু, বৈশালির লিচ্ছবি, কপিলাবস্তুর শাক্য, অল্লকপ্প দেশের কোলিয়গণ, রামগ্রামের কোলিয়গণ, বেটদ্বীপের ব্রাহ্মণগণ এবং পাবার মল্লগণের মধ্যে ভাগ করে দেন। দ্রোণ ব্রাহ্মণ যে কুম্ভ দিয়ে বুদ্ধের দেহাবশেষ ভাগ করেন সেই পাত্রটি নিজে গ্রহণ করেন। অতঃপর পিপ্পলিবনের মৌর্যগণ ‌এসে কিছু না পেয়ে চিতা থেকে অঙ্গার সংগ্রহ করে নিয়ে যান। পরবর্তীকালে প্রিয়দর্শী মহামতি অশোক বুদ্ধের অস্থিধাতুসমূহ উদ্ধার করেন এবং সমগ্র ভারতবর্ষে স্তূপ নির্মাণ করে সংরক্ষণ করেন।

    মহামানব বুদ্ধের পরিনির্বাণের বছর থেকে তাঁর নামে যে অব্দ গণনা করা হয় তা বুদ্ধাব্দ নামে পরিচিত। 'বুদ্ধ' শব্দের প্রকৃত আভিধানিক অর্থ জ্ঞানী। অন্যদিকে 'বুদ্ধ' নামটির তত্ত্বমূলক অর্থ হচ্ছে আলোকপ্রাপ্ত। বাস্তব সত্যের সন্ধান যিনি পেয়েছেন, যিনি সম্যক জ্ঞানের অধিকারী তিনিই বুদ্ধ। তাঁর আবিষ্কৃত সত্য বা মতবাদ অন্যদের তুলনায় ভিন্ন এবং বাস্তবধর্মী। তাই গৌতম বুদ্ধ যথার্থই বুদ্ধ। মহামানব বুদ্ধ যে সত্য ধর্ম প্রচার করে গেছেন তাতে কোনো ধরনের অন্ধবিশ্বাস বা কুসংস্কারের স্থান নেই। সেখানে দেব-দেবীর পূজা, ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি বা বিশ্বাসের স্থান নেই, আছে সর্বজন গ্রহণযোগ্য কতকগুলো নীতি, আদর্শ ও দর্শন। তিনি জ্ঞানীর শরণ, ন্যায়ের শরণ এবং একতার আশ্রয় গ্রহণের কথা বলেছেন। গৌতম বুদ্ধ একজন পরিপূর্ণ মানুষ, যিনি সমস্ত তৃষ্ণার বিনাশ সাধন করে সম্যক সম্বুদ্ধ রূপে জগতের সমস্ত জীবের মঙ্গলার্থে এবং দুঃখমুক্তির পথ দেখাতে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তথাগত বুদ্ধ 'দেব' বা 'অবতার' ছিলেন না। তিনি যথার্থই বুদ্ধ। তাঁর প্রবর্তিত ধর্মে মানুষে-মানুষে কোনো রকম বৈষম্য বা ভেদাভেদ নেই। বৌদ্ধ ধর্ম সুন্দর নীতিভিত্তিক এবং বিজ্ঞানসম্মত একটি ধর্ম।

    আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, বুদ্ধ পূর্ণিমা তিথিটি বৌদ্ধদের কাছে পবিত্রতম দিন। বুদ্ধ পূর্ণিমা তিথিকে বৌদ্ধরা সম্পূর্ণ ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে উদযাপন করে থাকে। তবে ভাষা, পরিবেশ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ভিন্নতার কারণে পৃথিবীর ভিন্ন-ভিন্ন অঞ্চলের বৌদ্ধ সম্প্রদায় ভিন্ন-ভিন্ন আঙ্গিকে বা আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে এ পূর্ণিমা তিথিকে উদযাপন করে থাকে। রাখাইন সম্প্রদায়ও তাদের কৃষ্টি এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনুযায়ী বুদ্ধ পূর্ণিমা (রাখাইন ভাষায় 'কাছুং লাহব্রে') তিথিকে উদযাপন করে থাকে। বুদ্ধ পূর্ণিমা বা 'কাছুং লাহব্রে' উপলক্ষ্যে যে উৎসব হয় তাকে রাখাইন ভাষায় 'ঞংরি লং পোয়ে' বলা হয়। বুদ্ধ পূর্ণিমা তিথিতে বোধিদ্রুম বা অশ্বত্থবৃক্ষের গোড়ায় জল ঢালা হয় বলে রাখাইন ভাষায় এ রকম নামকরণ (অশ্বত্থবৃক্ষকে রাখাইন ভাষায় 'ঞং পাং' বা 'বঃথি পাং' বলা হয়)। সিদ্ধার্থ গৌতম দীর্ঘ ছ'বছর সাধনার পর বোধিবৃক্ষের তলায় বুদ্ধত্ব লাভ করেছেন বলে প্রতিবছর বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন বিকাল বেলা বিহার আঙিনায় রোপণ করা বোধিবৃক্ষের গোড়ায় (প্রতি বছর একই গাছে) চন্দন মিশ্রিত জল ঢালা হয়। এর অর্থ হচ্ছে সিদ্ধার্থ গৌতমের বুদ্ধত্ব লাভকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা। বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষ্যে রাখাইন অধ্যুষিত কোনো-কোনো এলাকায় 'ওয়াংকাবাহ' (এক ধরনের চক্রব্যূহ) বসানো হয়। নারী-পুরুষ, ছোট-বড় সবাই ওই 'ওয়াংকাবাহ'-র অভ্যন্তরে প্রবেশ করে প্রদক্ষিণে অংশগ্রহণ করে। বিকালে বৌদ্ধ বিহার থেকে ধর্মীয় শোভাযাত্রা বার করা হয় এবং গ্রাম প্রদক্ষিণের পর পুনরায় বৌদ্ধ বিহারে এসে শেষ হয়। শোভাযাত্রা শেষে নির্দিষ্ট বোধিবৃক্ষের গোড়ায় চন্দন মিশ্রিত জল ঢালা হয়। এর পর সমবেত প্রার্থনা এবং পঞ্চশীল গ্রহণ করা হয়। পঞ্চশীল গ্রহণের পর বয়োজ্যেষ্ঠ বৌদ্ধ ভিক্ষু ধর্মীয় আলোচনা করেন। 'ঞংরি লং পোয়ে' উপলক্ষ্যে সেদিন রাতে 'জ্যাঃ' (গীত-নৃত্য-অভিনয়ের ত্রিসঙ্গমজাত নাট্য) পরিবেশনের আয়োজন করা হয়। ইদানীং 'জ্যাঃ'-এর পরিবর্তে লোকজ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ('রোঃরা পোয়ে') এবং 'প্রাজ্যাঃ' (মঞ্চ নাটক) পরিবেশন করতে দেখা যায়। এ ছাড়া বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন বয়স্ক রাখাইন নারী-পুরুষ পূত-পবিত্র হয়ে বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে উপোসথ বা অষ্টশীল পালন করে থাকেন।

    ধর্মযুদ্ধে পৃথিবী বহুবার নররক্তে প্লাবিত হয়েছে। অথচ বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে ও প্রসারে কখনো পৃথিবী একবিন্দু নররক্তে কলঙ্কিত হয়নি এবং একবিন্দু পশুরক্তে পবিত্র বৌদ্ধ মন্দির অপবিত্র হয়নি। বর্তমান সময়ে শান্তিকামী মানুষের উচিত হবে, মহামানব গৌতম বুদ্ধের অহিংসা, মৈত্রী ও করুণার বাণী দিয়ে হিংসার উন্মত্ত বিশ্বে পরম শান্তি স্থাপন করা।