বৃহস্পতিবার, মে ২৭, ২০১০

বুদ্ধ পূর্ণিমা ও রাখাইন সংস্কৃতি



জ (২৭ মে) শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা। এ পূর্ণিমা তিথিটি বৌদ্ধদের পবিত্রতম তিথি। এ তিথিটি বৈশাখ মাসে না পড়লেও বৈশাখি পূর্ণিমা নামে খ্যাত। বৌদ্ধদের কাছে এটিই বুদ্ধ পূর্ণিমা। বুদ্ধ পূর্ণিমা মহামানব গৌতম বুদ্ধের ত্রিস্মৃতি বিজড়িত একটি পবিত্র দিন। বুদ্ধ পূর্ণিমা তিথিতেই নিষ্পন্ন হয়েছিল ভাবী বুদ্ধ কুমার সিদ্ধার্থের মাতৃকুক্ষি হতে নিষ্ক্রমণ, বুদ্ধত্ব লাভ এবং মহা পরিনির্বাণ। খ্রিস্টপূর্ব ৬২৩ অব্দের বৈশাখি পূর্ণিমা তিথিতে লুম্বিনী কাননের শালতরুতলে কুমার সিদ্ধার্থের জন্ম হয়। জন্মের পর বড়-বড় রাজজ্যোতিষীগণ রাজকুমার সিদ্ধার্থের জন্মপঞ্জিকা তৈরি করেন। পণ্ডিতগণ কুমার সিদ্ধার্থের মধ্যে মহাপুরুষোচিত বত্রিশটি সুলক্ষণ দেখতে পান। বৌদ্ধদের পবিত্রতম গ্রন্থ ত্রিপিটকে এর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। কুমার সিদ্ধার্থের জন্মের সাতদিন পর তাঁর গর্ভধারিনী মহামায়া বা মায়াদেবী অকষ্মাৎ দেহ ত্যাগ করেন। মায়ের মৃত্যুর পর সৎমা বা মাসি গৌতমীর (মহামায়া এবং গৌতমী পরস্পর সহোদরা, রাজা শুদ্ধোদন দু'জনকেই বিয়ে করেন) দ্বারা পালিত হন বলে কুমার সিদ্ধার্থের নাম হয় গৌতম। ঊনত্রিশ বছর বয়সে রাজকুমার গৌতম রাজসুখ ছেড়ে গৃহত্যাগী হন। দীর্ঘ ছ'বছর কঠোর সাধনার পর খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৮ অব্দে আর এক বৈশাখি পূর্ণিমা তিথিতে পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে উরুবেলার নৈরঞ্জণা নদীর তীরে বোধিদ্রুম বা অশ্বত্থবৃক্ষের তলে রাজকুমার সিদ্ধার্থ গৌতম 'বুদ্ধত্ব' লাভ করেন। মহামানব গৌতম বুদ্ধ আশি বছর বয়সে খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৩ অব্দে আর এক বৈশাখি পূর্ণিমায় কুশীনগরের মল্লদের শালবনে পরিনির্বাণ লাভ করেন।

পরিনির্বাণের পর বুদ্ধের দেহাবশেষ দ্রোণ নামের এক ব্রাহ্মণ মগধের অজাতশত্রু, বৈশালির লিচ্ছবি, কপিলাবস্তুর শাক্য, অল্লকপ্প দেশের কোলিয়গণ, রামগ্রামের কোলিয়গণ, বেটদ্বীপের ব্রাহ্মণগণ এবং পাবার মল্লগণের মধ্যে ভাগ করে দেন। দ্রোণ ব্রাহ্মণ যে কুম্ভ দিয়ে বুদ্ধের দেহাবশেষ ভাগ করেন সেই পাত্রটি নিজে গ্রহণ করেন। অতঃপর পিপ্পলিবনের মৌর্যগণ ‌এসে কিছু না পেয়ে চিতা থেকে অঙ্গার সংগ্রহ করে নিয়ে যান। পরবর্তীকালে প্রিয়দর্শী মহামতি অশোক বুদ্ধের অস্থিধাতুসমূহ উদ্ধার করেন এবং সমগ্র ভারতবর্ষে স্তূপ নির্মাণ করে সংরক্ষণ করেন।

মহামানব বুদ্ধের পরিনির্বাণের বছর থেকে তাঁর নামে যে অব্দ গণনা করা হয় তা বুদ্ধাব্দ নামে পরিচিত। 'বুদ্ধ' শব্দের প্রকৃত আভিধানিক অর্থ জ্ঞানী। অন্যদিকে 'বুদ্ধ' নামটির তত্ত্বমূলক অর্থ হচ্ছে আলোকপ্রাপ্ত। বাস্তব সত্যের সন্ধান যিনি পেয়েছেন, যিনি সম্যক জ্ঞানের অধিকারী তিনিই বুদ্ধ। তাঁর আবিষ্কৃত সত্য বা মতবাদ অন্যদের তুলনায় ভিন্ন এবং বাস্তবধর্মী। তাই গৌতম বুদ্ধ যথার্থই বুদ্ধ। মহামানব বুদ্ধ যে সত্য ধর্ম প্রচার করে গেছেন তাতে কোনো ধরনের অন্ধবিশ্বাস বা কুসংস্কারের স্থান নেই। সেখানে দেব-দেবীর পূজা, ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি বা বিশ্বাসের স্থান নেই, আছে সর্বজন গ্রহণযোগ্য কতকগুলো নীতি, আদর্শ ও দর্শন। তিনি জ্ঞানীর শরণ, ন্যায়ের শরণ এবং একতার আশ্রয় গ্রহণের কথা বলেছেন। গৌতম বুদ্ধ একজন পরিপূর্ণ মানুষ, যিনি সমস্ত তৃষ্ণার বিনাশ সাধন করে সম্যক সম্বুদ্ধ রূপে জগতের সমস্ত জীবের মঙ্গলার্থে এবং দুঃখমুক্তির পথ দেখাতে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তথাগত বুদ্ধ 'দেব' বা 'অবতার' ছিলেন না। তিনি যথার্থই বুদ্ধ। তাঁর প্রবর্তিত ধর্মে মানুষে-মানুষে কোনো রকম বৈষম্য বা ভেদাভেদ নেই। বৌদ্ধ ধর্ম সুন্দর নীতিভিত্তিক এবং বিজ্ঞানসম্মত একটি ধর্ম।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, বুদ্ধ পূর্ণিমা তিথিটি বৌদ্ধদের কাছে পবিত্রতম দিন। বুদ্ধ পূর্ণিমা তিথিকে বৌদ্ধরা সম্পূর্ণ ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে উদযাপন করে থাকে। তবে ভাষা, পরিবেশ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ভিন্নতার কারণে পৃথিবীর ভিন্ন-ভিন্ন অঞ্চলের বৌদ্ধ সম্প্রদায় ভিন্ন-ভিন্ন আঙ্গিকে বা আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে এ পূর্ণিমা তিথিকে উদযাপন করে থাকে। রাখাইন সম্প্রদায়ও তাদের কৃষ্টি এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনুযায়ী বুদ্ধ পূর্ণিমা (রাখাইন ভাষায় 'কাছুং লাহব্রে') তিথিকে উদযাপন করে থাকে। বুদ্ধ পূর্ণিমা বা 'কাছুং লাহব্রে' উপলক্ষ্যে যে উৎসব হয় তাকে রাখাইন ভাষায় 'ঞংরি লং পোয়ে' বলা হয়। বুদ্ধ পূর্ণিমা তিথিতে বোধিদ্রুম বা অশ্বত্থবৃক্ষের গোড়ায় জল ঢালা হয় বলে রাখাইন ভাষায় এ রকম নামকরণ (অশ্বত্থবৃক্ষকে রাখাইন ভাষায় 'ঞং পাং' বা 'বঃথি পাং' বলা হয়)। সিদ্ধার্থ গৌতম দীর্ঘ ছ'বছর সাধনার পর বোধিবৃক্ষের তলায় বুদ্ধত্ব লাভ করেছেন বলে প্রতিবছর বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন বিকাল বেলা বিহার আঙিনায় রোপণ করা বোধিবৃক্ষের গোড়ায় (প্রতি বছর একই গাছে) চন্দন মিশ্রিত জল ঢালা হয়। এর অর্থ হচ্ছে সিদ্ধার্থ গৌতমের বুদ্ধত্ব লাভকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা। বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষ্যে রাখাইন অধ্যুষিত কোনো-কোনো এলাকায় 'ওয়াংকাবাহ' (এক ধরনের চক্রব্যূহ) বসানো হয়। নারী-পুরুষ, ছোট-বড় সবাই ওই 'ওয়াংকাবাহ'-র অভ্যন্তরে প্রবেশ করে প্রদক্ষিণে অংশগ্রহণ করে। বিকালে বৌদ্ধ বিহার থেকে ধর্মীয় শোভাযাত্রা বার করা হয় এবং গ্রাম প্রদক্ষিণের পর পুনরায় বৌদ্ধ বিহারে এসে শেষ হয়। শোভাযাত্রা শেষে নির্দিষ্ট বোধিবৃক্ষের গোড়ায় চন্দন মিশ্রিত জল ঢালা হয়। এর পর সমবেত প্রার্থনা এবং পঞ্চশীল গ্রহণ করা হয়। পঞ্চশীল গ্রহণের পর বয়োজ্যেষ্ঠ বৌদ্ধ ভিক্ষু ধর্মীয় আলোচনা করেন। 'ঞংরি লং পোয়ে' উপলক্ষ্যে সেদিন রাতে 'জ্যাঃ' (গীত-নৃত্য-অভিনয়ের ত্রিসঙ্গমজাত নাট্য) পরিবেশনের আয়োজন করা হয়। ইদানীং 'জ্যাঃ'-এর পরিবর্তে লোকজ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ('রোঃরা পোয়ে') এবং 'প্রাজ্যাঃ' (মঞ্চ নাটক) পরিবেশন করতে দেখা যায়। এ ছাড়া বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন বয়স্ক রাখাইন নারী-পুরুষ পূত-পবিত্র হয়ে বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে উপোসথ বা অষ্টশীল পালন করে থাকেন।

ধর্মযুদ্ধে পৃথিবী বহুবার নররক্তে প্লাবিত হয়েছে। অথচ বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে ও প্রসারে কখনো পৃথিবী একবিন্দু নররক্তে কলঙ্কিত হয়নি এবং একবিন্দু পশুরক্তে পবিত্র বৌদ্ধ মন্দির অপবিত্র হয়নি। বর্তমান সময়ে শান্তিকামী মানুষের উচিত হবে, মহামানব গৌতম বুদ্ধের অহিংসা, মৈত্রী ও করুণার বাণী দিয়ে হিংসার উন্মত্ত বিশ্বে পরম শান্তি স্থাপন করা।

কোন মন্তব্য নেই: