মঙ্গলবার, নভেম্বর ০৩, ২০০৯

মিয়ানমার সীমান্তে তিন কারণে ৬০ কিলোমিটার বেড়া

তিনটি কারণে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করেছে সে দেশের সামরিক জান্তা। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আরও অন্তত ৫০ কিলোমিটার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এ পরিকল্পনা সফল করতে সীমান্তরক্ষী নাসাকা বাহিনীর পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক সেনাসদস্য নিয়োগ করা হয়েছে। বেড়া নির্মাণের তিনটি কারণ হচ্ছে: জঙ্গি তত্পরতা বা হামলা প্রতিরোধ, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানো, চোরাচালান বন্ধ করে ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
জঙ্গি তত্পরতা বন্ধ: সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, মিয়ানমারের চারটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে বিভিন্ন দুর্গম পাহাড়ে আস্তানা গেড়ে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। স্বাধীন আরাকান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে এসব জঙ্গি সংগঠন মাঝে মধ্যে আরাকান রাজ্যে হামলা করে থাকে। বিলি করে প্রচারপত্র। এদের হামলা থেকে রক্ষা পেতে সামরিক জান্তা মিয়ানমার সীমান্তের ২৮৮ কিলোমিটার এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করছে। ইতিমধ্যে মিয়ানমারের মংডু শহরের মেডং নদী বা খাল থেকে উত্তর দিকে বলিবাজার পর্যন্ত প্রায় ৬০ কিলোমিটার এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে বলিবাজার থেকে তুমব্রু হয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের স্থলভাগের আরও ৫০ কিলোমিটার এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করবে।
টেকনাফ স্থলবন্দরে আমদানি পণ্য নিয়ে আসা মিয়ানমারের মংডু শহরের প্রভাবশালী এক ব্যবসায়ী জানান, আরাকানের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘আরএসও’ (আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন), ‘আরিফ’ (আরাকান ইসলামিক ফ্রন্ট)সহ অন্তত চারটি সংগঠনের জঙ্গিরা বিভিন্ন স্থানে আস্তানা গেড়ে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। এতে সামরিক জান্তা উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে এ কারণে মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিচ্ছে তারা।
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রোধ
মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা অন্য দেশে অনুপ্রবেশ করতে চাইলে সীমান্তরক্ষী ‘নাসাকা’ বাহিনীর সদস্যরা তাদের বাধা দেয় না। বরং ফিরে আসতে চাইলে বাধা দেয়। আগে বাংলাদেশসহ অন্য দেশ থেকে রোহিঙ্গাদের পুশব্যাক করলে তারা বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে নিজ দেশের নিজ গ্রামে সহজেই ঢুকে যেতে পারত। কিন্তু কাঁটাতারের বেড়া তৈরির ফলে এখন রোহিঙ্গারা সে সুযোগ পাচ্ছে না। মূলত এ লক্ষ্যেই বেড়া দিয়েছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা।
উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মাযহারুল আনোয়ার চৌধুরী জানান, পাঁচ মাস ধরে পালংখালী, উলুবনিয়া, রহমতেরবিল গ্রামসহ সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটছে। আগে বিডিআর জওয়ানেরা অনুপ্রবেশের সময় রোহিঙ্গাদের আটক করে নাফ নদের ওপারে মিয়ানমারে পুশব্যাক করতেন। তখন রোহিঙ্গারা সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমারে ঢুকে যেত। কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ায় রোহিঙ্গারা আর মিয়ানমারে ঢুকতে পারছে না।
টেকনাফ উপজেলা পরিষদের ভাইস-চেয়ারম্যান ইউনুস বাঙ্গালী জানান, প্রতিদিন সীমান্তের জাদিমুরা, দমদমিয়া, উলুবনিয়া, লম্বাবিল, হোয়াইক্যং, লেদাসহ বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশ ঢুকে পড়ছে। কিন্তু তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যাচ্ছে না। টেকনাফ উপজেলায় ইতিমধ্যে প্রায় ১০ হাজার অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা ঢুকে পড়েছে। ফলে দেশের মানুষ বেকার হচ্ছে। বন-জঙ্গল উজাড় হচ্ছে। চুরি-ডাকাতিসহ অপরাধকর্ম বেড়ে যাচ্ছে।
চোরাচালান বন্ধ করা
ভাইস-চেয়ারম্যান ইউনুস বাঙ্গালী জানান, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসে ধান চাল চিংড়ি কাঠ ও বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য। চোরাইপথে আসার কারণে আরাকানের সামরিক জান্তা বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে সে দেশে পাচার হয় ইউরিয়া সার, ডিজেল, ভোজ্যতেল, ওষুধ, সিমেন্ট, কাপড়চোপড়সহ দরকারি নানা পণ্য। এসব পণ্যে তাদের চাহিদা প্রবল বলে তারা সুবিধা আদায় করতে পারে না। বেড়া দিয়ে সামরিক জান্তা চোরাচালান বন্ধ করে এক জায়গা থেকে ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। আর এ কারণে কাঁটাতারের বেড়া দিচ্ছে।
সূত্র জানায়, টেকনাফ ৪২ রাইফেলস ব্যাটালিয়নের বিডিআর জওয়ানেরা আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে পাচারের সময় প্রায় পাঁচ কোটি টাকার চোরাইপণ্য জব্দ করেছেন। এ সময় ১১ পাচারকারীসহ ১৯টি নৌকা জব্দ করা হয়। টেকনাফ ৪২ রাইফেলস ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক মেজর শাহীনুর রহমান এর সত্যতা নিশ্চিত করেন।
উখিয়া-টেকনাফ (কক্সবাজার-৪) আসন থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সাংসদ আবদুর রহমান বলেন, মিয়ানমারের কাঁটাতারের বেড়ায় বাংলাদেশ লাভবান হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে চোরাইপণ্য পাচার বন্ধ হবে।
তবে স্থানীয় সাবেক সাংসদ ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শাহজাহান চৌধুরী বলেন, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে মিয়ানমার সীমান্তের জিরো পয়েন্টে বাঁধ এবং বাঁধের ওপর কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করতে পারে না। পাশাপাশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বাংলাদেশকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেবে।
গত রোববার সকালে উখিয়া উপজেলার বালুখালী ঘুমধুম সীমান্ত পরিদর্শন করে মিয়ানমারের তুমব্রু, বলিবাজার এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া তৈরির দৃশ্য দেখা গেছে। পাশে দাঁড়িয়ে অস্ত্রধারী সীমান্তরক্ষীরা কাজের তদারক করছেন।
জেলা প্রশাসক মো. গিয়াস উদ্দিন আহমদ জানান, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে তিনি সম্প্রতি সরকারের কাছে আট দফা সুপারিশ পেশ করেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ, কক্সবাজার জেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের তালিকা তৈরি করে এক জায়গায় নিয়ে আসা, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে পুশব্যাক জোরদার, সীমান্তে বিডিআরের নজরদারি, নাফ নদে কোস্টগার্ডের টহল বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
(সৌজন্যে: প্রথম আলো, ০৭ অক্টোবর ২০০৯)

কোন মন্তব্য নেই: