শুক্রবার, সেপ্টেম্বর ০৩, ২০১০

তাঁত: জেগে উঠেছে রাখাইনপল্লি

 
রগুনার বঙ্গোপসাগরের তীরে আদিবাসী রাখাইনপল্লিগুলোতে এখন উত্সবের আমেজ। বড় বড় কুপিবাতি জ্বালিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত চলছে তাঁতে কাপড় বোনার কাজ। দিন-রাতে এখন সমান ব্যস্ততা। সামনে ঈদ, তাই তাঁতগুলোর খটখট শব্দে পল্লিগুলো মুখর হয়ে উঠেছে। রংবেরঙের কাপড় বুনে সেগুলো দেশের বিভিন্ন স্থানের বাজারে পাঠানো থেকে শুরু করে সব কাজই করতে হচ্ছে রাখাইন নারীদের। তাঁদের এখন অবসর নেই।
    এখানে উত্পাদিত কাপড় যাচ্ছে ঢাকা, বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি আর কুয়াকাটার বাজারে। ঈদের ছুটিতে পর্যটকেরা কুয়াকাটা, রাঙামাটি, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে বেড়াতে আসবেন। পর্যটকদের চাহিদা অনুযায়ী এসব এলাকার ব্যবসায়ীরা আগেভাগেই আদিবাসী রাখাইনদের হস্তচালিত তাঁতে বোনা বাহারি রঙের কাপড় যেমন—থামি, লুঙ্গি, শার্টপিস, শাড়ি, গামছা, বিছানার চাদর, থ্রিপিস, হাতব্যাগ সংগ্রহ করছেন। এসবের জোগান দিতেই বেড়ে গেছে রাখাইনপল্লীবাসীর ব্যস্ততা।

    রাখাইন সমাজকল্যাণ সংস্থার সদস্য সচিব খে মংলা জানান, তালতলীর ১৩টি আদিবাসী পাড়ায় হাতে চালিত প্রায় ৩০০ তাঁত রয়েছে। এই তাঁতগুলো আদিবাসীদের ঐতিহ্যের ধারক। প্রায় ২০০ বছর ধরে তাঁত বুনে নিজেদের পরিধেয় কাপড়ের চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত কাপড় বিক্রি করে রাখাইনরা বাড়তি আয় করে জীবিকা নির্বাহ করছে। রাখাইনদের মধ্যে এমন রীতি ছিল যে, কোনো রাখাইন মেয়ে হস্তচালিত তাঁত বুনতে না পারলে সেই মেয়ের বিয়েই হতো না। এখন নানা করণে সেই রীতির পরিবর্তন ঘটেছে। অনেক পরিবার যেমন এখান থেকে বিলুপ্ত হয়েছে, তেমনি তাঁতগুলোও অচল হয়ে পড়েছে।

    খে মংলা আরও জানান, প্রতিকূলতার মধ্যেও তালতলী থানার তালতলীপাড়া, ছাতনপাড়া, মনুখেপাড়া, আগাঠাকুরপাড়া, সওদাগরপাড়া, তালুকদারপাড়া, কবিরাজপাড়া, তাঁতিপাড়া, লাউপাড়া ও অঙ্কুজানপাড়ায় রাখাইনপল্লিগুলোতে প্রায় ৩০০ হস্তচালিত তাঁত রয়েছে। ইদানীং রাখাইনদের তাঁতের কাপড়ের জনপ্রিয়তাও বেড়েছে। এতে তাঁতে আবার সুদিনের আভাস মিলেছে। তবে সুতার দুষ্প্রাপ্যতা ও মূল্য বৃদ্ধির কারণে তাঁতিরা তেমন লাভের মুখ দেখতে পাচ্ছেন না।

    তালতলীর আদিবাসী পল্লিগুলোতে গিয়ে দেখা গেল, তাঁতিদের কোলাহল আর কর্মব্যস্ততায় বোঝার উপায় নেই যে কদিন আগেও এসব পল্লির তাঁতগুলো নিষ্ক্রিয় পড়ে ছিল। ধুলাবালু আর মাকড়সার জঞ্জালে আচ্ছন্ন তাঁতঘরগুলো এখন পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি। চলছে খটখট শব্দ করে।

    তাঁতের দুর্দশা আর সম্ভাবনার কথা বলতে গিয়ে তালুকদারপাড়া রাখাইনপল্লির গৃহিণী মাচেজেন রাখাইন বলেন, ‘রাখাইন তাঁতিদের উত্পাদিত বস্ত্রের কদর দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের সর্বত্র থাকলেও ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, বাজারজাতকরণে সমস্যা এবং আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারায় এখানে তাঁতির সংখ্যা কমেছে। সুতার মূল্য বৃদ্ধি আর পুঁজির অভাব আমাদের মেরুদণ্ড সোজা করতে দিচ্ছে না।’

    রাখাইনদের হস্তচালিত তাঁতে বোনা কাপড়ে বাহারি ও ঝলমলে রঙের ব্যবহার এবং লতাপাতা, ফুল, পাখি ও প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গের অলংকরণ বৈচিত্র্য এনেছে এসব কাপড়ে। এ প্রসঙ্গে মাচেজেন বলেন, ‘রাখাইনরা ঐতিহ্যগতভাবেই সবকিছুতে রঙের জৌলুশ, প্রকৃতি ও জীবজন্তুর প্রতি বেশি সংবেদনশীল। পোশাকে ও সংস্কৃতিতে এটা বেশি পরিলক্ষিত হয়। এ জন্য তাঁতে বোনা কাপড়ে ছয় থেকে আট ধরনের রং আমরা ব্যবহার করি। এসব রং কৃত্রিম নয়, প্রকৃতি থেকে নেওয়া। যেমন সুতায় বিভিন্ন রং করতে আমরা শাল, বকুলসহ বিভিন্ন গাছের পাতা ও বাকল ব্যবহার করি। এতে রং খুব টেকসই হয়। পাশাপাশি বাজারের অন্য যেকোনো কাপড়ের তুলনায় আমাদের কাপড়ের রং থাকে আলাদা।’

    কুয়াকাটার পাইকারি কাপড় ব্যবসায়ী মংচান বলেন, ‘এখান থেকে কাপড় ও অন্যান্য পণ্য নিয়ে কুয়াকাটা, কক্সবাজারে পাঠাই। ঈদ সামনে রেখে কুয়াকাটা ও কক্সবাজারে এসব পণ্যের খুব চাহিদা এখন।’

    লোকসান গুনতে গুনতে রাখাইন তাঁতিরা একসময় ঋণে জর্জরিত হয়ে পুরোনো পেশা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁদের অনেকে আবার পুরোনো তাঁত সচল করেছেন। যাঁরা পোড় খেয়ে পূর্বপুরুষের এই পেশা ধরে রেখেছেন, তাঁরা আবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন।

    সৌজন্যে: প্রথম আলো, শুক্রবার, ০৩ সেপ্টম্বর ২০১০